চতুর্থবারের মত পা দিয়ে লিখে জিপিএ-৫ পেলেন তামান্না

জন্ম থেকে দুটি হাত নেই; নেই ডান পা। শুধু বাঁ পা দিয়ে লিখে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তামান্না আক্তার নূরা। আজ রোববার পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এসএসসির মতো এইচএসসিতেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি। একই ফল করেছিলেন পিইসি ও জেএসসিতেও। অদম্য তামান্নার স্বপ্ন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা হওয়া।

তামান্না যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুর গ্রামের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীনের মেয়ে। তামান্না যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তামান্না ২০১৯ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরীক্ষার ফল পাঁচে পাঁচ।

বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার ছোট পৌদাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার (নন–এমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজ প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।

তামান্না বলেন, ‘আমার ইচ্ছা মানুষ হওয়ার। ছোটবেলা থেকেই আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য আমি ডাক্তার হতে পারব না। এ জন্য আমার ইচ্ছা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব। লেখাপাড়া শেষ করে আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা হব।’

পা দিয়ে লিখে এইচএসসি পরীক্ষায়ও বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছেন তামান্না আক্তার নূরা। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুর গ্রামে

তামান্নাকে আলোকিত করতে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছেন মা খাদিজা। তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তামান্নার জন্ম। ওর জন্মের পর কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে ভেবেছি, ওকে কারও বোঝা হতে দেওয়া ঠিক হবে না। ছয় বছর বয়সে ওর পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করলাম। কলম দিলাম। কাজ হলো না। এরপর মুখে কলম দিলাম, তাতেও কাজ হলো না। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওকে পা দিয়েই লেখাতে হবে। এরপর বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি করালাম। মাত্র দুই মাসের মাথায় ও পা দিয়ে লিখতে শুরু করল। এরপর ছবি আঁকা শুরু করল।’

খাদিজা জানালেন, তাঁর মেয়ের পড়াশোনায় শারীরিক সীমাবদ্ধতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) জিপিএ-৫ পান তামান্না, পান বৃত্তিও। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায়ও (জেএসসি) জিপিএ-৫ পান তিনি। কঠোর পরিশ্রমে সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন এসএসসি ও এইচএসসিতেও।

মেয়ের সাফল্যে যারপরনাই খুশি বাবা রওশন আলী। তিনি বলেন, ‘তামান্নার জন্মের পর থেকে নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাদের। তারপরও হাল ছাড়িনি। মেয়েটার জন্য ঠিকমতো কোনো কাজ করতে পারি না। সারাক্ষণ ওর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। শরীরে একটা মশা পড়লেও তাড়াতে পারে না। তামান্নার শ্রবণ ও মেধাশক্তি খুব ভালো। পরীক্ষায় সে খুব ভালো ফল করেছে। আমি খুবই খুশি। সরকারি সহায়তা পেলে আমি মেয়েটির ইচ্ছা পূরণ করতে পারব।’

বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. সামছুর রহমান বলেন, ‘তামান্না প্রতিবন্ধী। তার দুটি হাত ও একটি পা নেই। সে অত্যন্ত মেধাবী। পা দিয়ে লেখে। ওর লেখা স্পষ্ট, দৃষ্টিনন্দন। তামান্না ভালো ছবিও আঁকে। ভালো তার্কিকও। তামান্নার জন্য একটি ছোট চৌকি তৈরি করা হয়েছিল। সেই চৌকিতে বসে সামনে খাতা রেখে সে বাঁ পায়ের দুই আঙুলে রাখা কলম দিয়ে লিখে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষায় সে জিপিএ–৫ পেয়েছে। সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সে ভালো ফল করেছে। তামান্নার ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। একটু সহায়তা পেলে তামান্না ভবিষ্যতে অনেক ভালো করবে।’

পাঠকের মন্তব্য