প্রতিযোগিতাকে ছাড়িয়ে যেখানে বন্ধুত্বই মূল্যময়

 

বেশ কয়েক বছর আগে মাইক্রোসফটের বিপণন বিভাগের প্রধান ঘোষণা দেন, ‘অ্যাপলের সঙ্গে আর লড়াই নয়। সব লড়াইয়ের অবসান হয়েছে।’ এটি বেশ চমকপ্রদ ঘোষণাই ছিল প্রযুক্তি দুনিয়ার জন্য। বিশেষ করে যাঁরা পরিচিত ছিলেন দুই প্রযুক্তি জায়ান্টের দ্বন্দ্বের সঙ্গে। 

প্রযুক্তি দুনিয়ার দুই মহারথী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এবং অ্যাপলের স্টিভ জবস। সত্তরের দশকে এই দুজনই প্রযুক্তি দুনিয়ায় ঘটান বিপ্লব। তবে তাঁদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার লড়াই যেন অম্লমধুর সম্পর্কের এক শোকগাথা।

মজার বিষয় হচ্ছে, দুজনের জন্ম একই বছরে, ১৯৫৫ সালে। জবসের থেকে মাস আটেকের ছোট গেটস। কাজের ধারাও একই রকমের, একই বিষয় নিয়ে। 

তবে দুজনের মধ্যে এই মিল যেন এনে দিয়েছিল তাঁদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা। সুসম্পর্ক থাকলেও ব্যবসায়িক স্বার্থে কেউ কাউকে ছাড় দেননি। আবার বন্ধু স্টিভ জবসের দুর্দিনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে অন্য রকম এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বিল গেটস।

 খুব কাছাকাছি সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যাপল ও মাইক্রোসফট। অ্যাপল কম্পিউটার তৈরি করত, অন্যদিকে মাইক্রোসফট সফটওয়্যার তৈরিতে মনোযোগ দেয়।

৪৩ বছর আগে প্রথম অ্যাপল কম্পিউটার নিয়ে আসেন স্টিভ জবস ও প্রকৌশলী স্টিভ ওজনিয়াক। জবস বের করতেন নতুন আইডিয়া আর দেখতেন ব্যবসায়িক দিকটি। অন্যদিকে অ্যাপল-১ কম্পিউটার উদ্ভাবন করেন ওজনিয়াক।

রোনাল্ড ওয়েন নামে আরেক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে জবসের বাসার গ্যারেজে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করা হয়। অল্প কিছুদিন পর ওয়েন, জবস এবং ওজনিয়াককে ছেড়ে চলে যান।

এর আগে কম্পিউটারের একেকটা অংশ ছড়ানো–ছিটানো ছিল এবং এটি বসানোর জন্য অনেক জায়গা লাগত। জবসই প্রথম কম্পিউটারকে বর্তমানের মতো একটি সুন্দর আঙ্গিকে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে একই সময়ে হার্ভার্ড থেকে ঝরে পড়া এক হ্যাকারও কম্পিউটারে প্রাণসঞ্চারের জন্য কাজ করছিলেন।

তিনি সরাসরি কি–বোর্ড চেপে কম্পিউটারে কমান্ড দেওয়ার এক প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যা পরে ১৯৭৭ সালে অ্যাপল-২ এ ব্যবহৃত হয়। এই হ্যাকার আর কেউ নন, বিল গেটস।

একসময় অ্যাপলের জন্য সফটওয়্যার বানালেও সব সময় জবসকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা ছিল গেটসের মধ্যে। মজার বিষয় হচ্ছে, খুব তরুণ বয়সেই ক্রমবর্ধমান একটি বাজারের মূল মাথা হয়ে ওঠেন জবস ও গেটস।

আশির দশকের শুরুতে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা আইবিএমে যোগ দেন গেটস। ব্যক্তিগত কম্পিউটার তৈরিতে তখন মনোযোগ দেয় আইবিএম। 

গেটস ও জবসের মধ্যে জটিল সম্পর্কের শুরুটা হয় তখন থেকেই। অবশ্য ওই সময় বেশ নামডাক হয় অ্যাপলের, বেশি পরিচিতি পান স্টিভ জবস। শুরুতে কয়েক বছর মাইক্রোসফট ও অ্যাপল হাতে হাত মিলিয়েই কাজ করেছিল।

তবে মাইক্রোসফট যখন তার নতুন অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ আইবিএমের জন্য চালু করল, তখন থেকেই তাদের দূরত্ব তৈরি হলো।

১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে লিসা কম্পিউটার আনেন স্টিভ জবস। যাতে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয় গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস (জিইউআই)। এর মধ্যে বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী আইবিএম ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবসায় চলে এলে নতুন কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করে অ্যাপল। 

নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমসহ ব্যক্তিগত কম্পিউটার ম্যাকিনটোশ বানানো শুরু করেন জবস, এতে ইন্টিগ্রাল গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস ও প্রথমবারের মতো মাউস ব্যবহৃত হয়। একসময় ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের প্রোগ্রামিংয়ের জন্য বিল গেটসের সাহায্য নেন জবস। বিল গেটস সাহায্য করেন। 

পরে ওই সময়ই উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম বানান জবস। আর এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অ্যাপলের দাবি, এতে ম্যাকিনটোশের আইডিয়া নিয়েছিলেন গেটস। সমস্যা আরও বড় আকার ধারণ করে যখন ম্যাকিনটোশ রিলিজের আগেই বিল গেটস উইন্ডোজ তৈরির ঘোষণা দেন।

অবশ্য ১৯৮৫ সালের ২০ নভেম্বর উইন্ডোজ ১.০ বাজারে আনে মাইক্রোসফট। এর কয়েক বছর পরেই বাজারে চলে আসে উইন্ডোজ ২.০। যাতে ম্যাকিনটোশ ইন্টারফেসের প্রথম সংস্করণের বেশ মিল ছিল। 

এতে ক্ষিপ্ত হয় অ্যাপল। ১৯৮৮ সালের ১৭ মার্চ মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইন ভঙ্গের অভিযোগ এনে মামলা করে অ্যাপল ইনকরপোরেটেড। মামলার অভিযোগে বলা হয়, উইন্ডোজে ব্যবহার করা জিইউআই অ্যাপলের ম্যাকিনটোশ অপারেটিং সিস্টেম থেকে চুরি করা। 

মামলায় অ্যাপল অপারেটিং সিস্টেমের আরও ২০০ জিইউআই উপাদানের মিল তুলে ধরে, যার বিষয়ে মাইক্রোসফটের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। আলোচিত এ মামলা সম্পর্কে সে সময় বিল গেটস বলেছিলেন, ‘আমরা উইন্ডোজে জিইউআই কোথাও থেকে নিইনি।

এর আইডিয়া, কার্যক্রম পুরোপুরি মাইক্রোসফটের প্রকৌশলীদের করা।’ ১৯৯৩ সালে এ মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং মাইক্রোসফটের পক্ষে রায় হয়। 

এদিকে অ্যাপলের বিশেষ করে জবসের সময়ও ভালো যাচ্ছিল না। মার্কেটে নানা কারণে ম্যাকিনটোশ মার খেয়ে যায়। অন্যদিকে উইন্ডোজ ব্যাপক সাড়া পায়। 

মাইক্রোসফট আর আইবিএম প্রচুর লাভ করে। বিল গেটসের সম্পদের পরিমাণও ফুলে–ফেঁপে ওঠে। অন্যদিকে ম্যাকিনটোশ বাজারে এনে অ্যাপলকে অনেক টাকার লোকসান গুনতে হয়। যার জেরে ১৯৮৫ সালে নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ব্যবস্থাপকের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় জবসকে।

তবে পরে এর জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান বলেই মনে করেন স্টিভ জবস। ওই বরখাস্ত হওয়া তাঁকে নতুন করে আবিষ্কারক হতে সাহায্য করেছিল। অ্যাপল ছাড়ার পর নেক্সট কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন জবস। তবে এটি তেমন সফল ছিল না। 
১৯৯০ সালে নেক্সট সফটওয়্যার অ্যাপল এবং আইটিউন্স স্টোরে ওয়েব-অবজেক্টরের ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে স্টিভ তো আর হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। তাঁকে সাফল্য আর সুনাম এনে দেয় কম্পিউটার গ্রাফিকস ভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পিক্সার।

ডিজনির সঙ্গে মিলে টয় স্টোরি, আ বাগস লাইফ এবং ফাইন্ডিং নিমোর মতো হিট অ্যানিমেশন সিনেমা তৈরি করে পিক্সার। ১৯৯৬ সালে প্রায় ৪৩ কোটি ডলারে নেক্সট কিনে নেয় অ্যাপল। স্টিভ জবসও ফিরে পান অ্যাপলের প্রধান নির্বাহীর পদ। তবে এই এক যুগ বিল গেটসের জন্য ফাঁকা ময়দান ছিল। 

অপারেটিং সিস্টেমে তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না।১৯৯৭ সালের আগস্টে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা অ্যাপলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন বিল গেটস।

১৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি করে দুই প্রতিষ্ঠান। সে সময় গেটসের উদ্দেশে জবস বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ বিল, এই বিশ্ব খুবই অসাধারণ জায়গা।’

এই বিনিয়োগে ব্যবসায়ী গেটসের নিজের কোনো সুবিধা হয়নি, তা নয়। তবে ডুবতে থাকা অ্যাপল যেন নতুন প্রাণ পায়। টিকে থাকার জন্য, জবসকে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার বাইরে যেতে হয়। অ্যাপলকে রীতিমতো ঢেলে সাজান স্টিভ জবস। 

বন্ধ করে দেন অনেক প্রকল্প। চালু করেন নতুন নতুন পণ্য। বাজারে আনেন সহজে বহন করা মিউজিক ডিভাইস আইপড। এটি অ্যাপলের জন্য বিপ্লব নিয়ে আসে। ২০০৭ সালে বাজারে আসে অ্যাপলের মোবাইল ফোন আইফোন।

তবে ১৯৯৭ সালের ওই চুক্তি তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগিতার সমাপ্তি টানেনি। এরপরও বহুদিন প্রযুক্তি দুনিয়ায় প্রতিযোগিতা করে গেছে অ্যাপল ও মাইক্রোসফট। 

তবে দুই মহারথীর মধ্যকার প্রতিযোগিতা যেন থামিয়ে দেয় প্রকৃতি। ২০১১ সালে মারা যান স্টিভ জবস। তাঁর মৃত্যুর পর গেটস বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর আগে আমাদের দুজনের প্রথম দেখা হয়। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময়ের সহকর্মী, প্রতিযোগী এবং বন্ধু, যাকে আজ হারালাম।

বিশ্বে স্টিভের মতো প্রভাব ফেলা মানুষ খুব কমই দেখা গেছে। ভবিষ্যতে বহু প্রজন্মও একইভাবে প্রভাবিত হবে। তার সঙ্গে কাজ করা ভাগ্যবানদের মধ্যে আমি একজন। আমি স্টিভকে অনেক মিস করব।’ সূত্র:প্রথম আলো

এশিয়ামেইল২৪

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পাঠকের মন্তব্য