শিশু চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করে মাতৃভাষার মাধ্যমেই। ছবি: সংগ্রহীত

জানেন কী! মাতৃভাষা জ্ঞান অর্জনের জন্য কেন অপরিহার্য?

একটি জাতি তার ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য কেন জীবন দিতে পিছপা হয় না, সেটা আমরা আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝি। কারণ, ভাষা মানে শুধু কিছু শব্দ বা বাক্য নয়; ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ওই জাতির সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ, জীবনের নানা সম্পর্ক, চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা—এক কথায় সামগ্রিক সামাজিক অস্তিত্ব।

সুতরাং মাতৃভাষা না থাকলে সমাজের মানুষগুলোরও অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। সাধারণভাবে বলা যায়, ভাষা ছাড়া মানুষ পরস্পরের মধ্যে ভাববিনিময়, এমনকি চিন্তাভাবনা পর্যন্ত করতে পারে না। এটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। আমরা যখনই মনে মনে কিছু চিন্তা করি, সেটা করতে হয় কোনো ভাষার মাধ্যমে।

একবার রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক (১১৯৪—১২৫০) কিছু অনাথ শিশুকে একটি প্রাসাদে আলাদা করে রাখার আদেশ দেন। নির্দেশ দেওয়া হয়, যেন তাদের সামনে কেউ কোনো কথা না বলে বা কোনো রকম আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ না ঘটায়। তাদের খাওয়া-থাকার চমৎকার ব্যবস্থা করা হয়। সম্রাট দেখতে চেয়েছিলেন ওই শিশুরা নিজ থেকে কোন ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। ধারণা করা হয়েছিল, হয়তো তারা গ্রিক, লাতিন বা হিব্রু ভাষায় কথা বলবে। কিন্তু দেখা গেল তারা কোনো ভাষাতেই কথা বলতে পারল না; তাদের মৃত্যু হলো।

১৩৩৮ সালে প্রকাশিত ‘আলেক্সান্ডার রোমান্স’ বইয়ের ‘চিলড্রেন প্লেইং’ অলংকরণ থেকে

১৩৩৮ সালে প্রকাশিত ‘আলেক্সান্ডার রোমান্স’ বইয়ের ‘চিলড্রেন প্লেইং’ অলংকরণ থেকে। ছবি: বোদলিয়ান লাইব্রেরি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

এ ধরনের আরও অনেক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ভাষা শুধু মানবজীবনের সৃজনশীল অবদানই নয়, সেটা জীবনের অস্তিত্বেরও অন্যতম শর্ত। মাতৃভাষার গুরুত্ব এখান থেকেই বোঝা যায়। শিশু যখন মায়ের মুখ থেকে কোনো শব্দ ও বাক্য শোনে, তখন সে মায়ের মুখের প্রকাশভঙ্গি খেয়াল করে। এ ছাড়া মায়ের আবেগ-অনুভূতিসহ ওই শব্দের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের সূত্রগুলো মিলিয়ে নেয়।

সুতরাং মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে মাতৃভাষার অবদান অসামান্য। মাতৃভাষা সহজে শেখা যায়, প্রাথমিকভাবে এর জন্য ব্যাকরণ শিখতে হয় না। শিশু চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করে মাতৃভাষার মাধ্যমেই। এরপর দ্বিতীয় কোনো বিদেশি ভাষা শিখতে চাইলে সেটা সে পারে অনায়াসে।

শিশু যখন মায়ের মুখ থেকে কোনো শব্দ ও বাক্য শোনে, তখন সে মায়ের মুখের প্রকাশভঙ্গি খেয়াল করে

শিশু যখন মায়ের মুখ থেকে কোনো শব্দ ও বাক্য শোনে, তখন সে মায়ের মুখের প্রকাশভঙ্গি খেয়াল করে| ছবি: সংগ্রহীত

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রথমে মাতৃভাষা আত্মস্থ করে, তারা অন্যদের তুলনায় দ্রুত ও সহজে দ্বিতীয় কোনো ভাষা আয়ত্ত করতে পারে। যেমন, মাতৃভাষা বাংলা ভালোভাবে জানলে সহজে ইংরেজি বা অন্য ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা যায়। আর বিভিন্ন ভাষা জানলে বিশ্ব-জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করা যায় সহজে। এ জন্যই বলা হয়, জ্ঞান অর্জনের ভিত্তি রচনা করে মাতৃভাষা।

পাঠকের মন্তব্য