দায়িত্বশীলতা বনাম জবাবদিহীতা

রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) জবাবদিহিতার কারণে ইসলামের সৌন্দর্য শুধু নয় বরং তার গ্রহণযোগ্যতাও সৃষ্টি হয়েছে সবার কাছে।জবাবদিহিতার অনুভূতি  হ্রাস পেলে মানবজীবনে অধঃপতন নেমে আসে।

দায়িত্বশীলকে দুটি জায়গায় জবাবদিহি করতে হয়। এক. মানুষের কাছে জবাবদিহি দুই. আল্লাহর কাছে জবাবদিহি। মানুষের কাছে জবাবদিহির অনুভূতি কমে গেলে বা বিলুপ্ত হলে মানুষ যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভূতি কমে/হারিয়ে গেলে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَخْفَىٰ عَلَيْهِ شَىْءٌ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَا فِى ٱلسَّمَآءِ 
 ‘আল্লাহর কাছে জমিন ও আসমানের কোনো কিছুই গোপন থাকে না।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত : ৫)

তিনি আরও বলেন,

يَعْلَمُ خَآئِنَةَ ٱلْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِى ٱلصُّدُورُ 
 ‘মানুষের চোখের গোপন চাহনি এবং তাদের অন্তরে যা কিছু লুকিয়ে থাকে, সবই তিনি জানেন।’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ১৯)

যদি প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সজাগ হয় এবং আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি হৃদয়ে জাগ্রত  রাখে তাহলে সমাজের সিংহভাগ অভিযোগ ও সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কারণ, মুমিনের সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য । আল্লাহর ভয়ে অন্যায় থেকে বিরত থাকে। নিশ্চয় সে জানে যে, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে, তা সে (কেয়ামতের দিন) দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলে, তাও সে দেখতে পাবে।’ (সুরা যিলযাল, আয়াত : ৭-৮)

দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন সৎকাজের ওজনের পাল্লা হালকা হওয়ার ভয়েই তিনি খেলাফতকালে এক প্রকার নির্ঘুম রাত কাটাতেন। তিনি বলতেন, যদি আমি রাতে ঘুমাই, তাহলে আমি নিজেকে ধ্বংস করলাম। আর যদি দিনে ঘুমাই, তাহলে প্রজাদের শেষ করলাম। কেননা আমি তাদের ওপর দায়িত্বশীল। (আল-খুতাত লিল মাকরিজি : ১/৩০৮)

ইসলামের পঞ্চম খলিফা খ্যাত উমর বিন আবদুল আজিজ (৯৯-১০১ হিজরি) একবার রাতের বেলা মোটা মোমবাতি জ্বেলে কর্মকর্তাদের ডেকে প্রজাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হচ্ছিলেন। এমন সময় একজন বলে উঠল, হে আমিরুল মুমিনিন!

আপনার নিজের অবস্থা এবং পরিবারের অবস্থা কেমন? তখন তিনি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন এবং গোলামকে উচ্চঃস্বরে ডেকে বললেন, চেরাগবাতি নিয়ে আসো। কিছুক্ষণ পরে চেরাগ এলো, তবে তা নিবু নিবু ছিল। তখন তিনি বললেন, তুমি এখন যা খুশি আমাকে প্রশ্ন করো। এরপর তিনি তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন। প্রশ্নপর্ব শেষে ওই ব্যক্তি তাকে বড় মোমবাতিটি নিভিয়ে দিয়ে নিবু নিবু চেরাগ আনার কারণ কী জানতে চাইলেন। 

জবাবে খলিফা বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! বড় মোমবাতিটি আমি নিভিয়ে দিয়েছি, কারণ সেটি ছিল আল্লাহর ও মুসলমানদের সম্পদ। তার আলোয় আমি প্রজাদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিলাম। কিন্তু যখন তুমি আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে, তখন আমি তাদের মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলাম। (সিরাতু উমর ইবনু আবদুল আজিজ : ১৩৭-৩৮ পৃষ্ঠা)

জবাবদিহির অনুভূতি ও দায়িত্বজ্ঞানের তীব্রতা মুসলিম নেতাদের মধ্যে কেমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। এক দিন তিনি প্রচণ্ড সূর্যতাপে সদকার উটের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় বনু তামিম গোত্রের নেতা আহনাফ বিন কায়েস ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আসেন। 

যখন তারা তার নিকটবর্তী হলেন, তখন উমর (রা.) আহনাফকে ডেকে বললেন, হে আহনাফ! কাপড়-চোপড় রেখে দ্রুত এসো এবং উট পরিচর্যার ব্যাপারে আমিরুল মুমিনিনকে সাহায্য করো। কেননা এগুলো সদকার উট। এর মধ্যে এতিম-মিসকিন ও বিধবাদের হক রয়েছে।

তখন একজন বলল, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি সদকা খাতের কোনো একজন কর্মীকে এ কাজের নির্দেশ দিলেই তো যথেষ্ট ছিল। জবাবে উমর (রা.) বললেন, আমার চেয়ে ও আহনাফের চেয়ে বড় গোলাম আর কে আছে? কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোনো দায়িত্বে থাকে, তার ওপর ওভাবে দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব, যেভাবে মনিবের প্রতি একজন গোলামের দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক।’ (তারিখু উমর লি-ইবনিল জাওজি, পৃষ্ঠা : ৮৯)

আব্বাসীয় খলিফা মুক্তাদি বি আমরিল্লাহর (৪৬৭-৪৮৭ হিজরি) মন্ত্রী আবু শুজার কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘আমাদের প্রতিবেশী একজন বিধবা আছেন, যার চারটি সন্তান রয়েছে। ওরা কাপড়-চোপড়হীন ও ক্ষুধার্ত।’ কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী একজন লোক দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র ও কিছু নগদ অর্থ পাঠিয়ে দেন। 

অতঃপর তীব্র শীত পড়া অবস্থায় নিজের দেহের পোশাক খুলে রেখে দিয়ে বলেন, আল্লাহর কসম! যতক্ষণ পর্যন্ত এই ব্যক্তি আমার কাছে তাদের খবর না নিয়ে আসবে, ততক্ষণ আমি এই পোশাক পরব না। লোকটি দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে এসে বলল, তারা খুবই খুশি হয়েছে এবং মন্ত্রীর জন্য দোয়া করেছে। এ কথা শোনার পর মন্ত্রী তার কাপড় পরলেন। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ : ১২/১৫০-৫১)


রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ কোনো বান্দাকে যদি মানুষের দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেন, অতঃপর সে তাদের ওপর খেয়ানতকারী হিসেবে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেন। কেবল শাসকই নন, বরং যেকোনো দায়িত্বশীলের জন্য এই হুকুম।

বয়স, যোগ্যতা ও পদমর্যাদা হিসেবে মানুষের জবাবদিহির তারতম্য হয়ে থাকে। সেদিকে লক্ষ করেই রাসুল (সা.) বলেন, ‘মনে রেখো তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাদের ওপর দায়িত্বশীল। সে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। 

ব্যক্তি তার পরিবারের ওপর দায়িত্বশীল। সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তানদের ওপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের ওপর দায়িত্বশীল। সে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

আল্লাহতায়ালা বলেন, 

حَتَّىٰٓ إِذَا مَا جَآءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَٰرُهُمْ وَجُلُودُهُم بِمَا كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ 

وَقَالُوا۟ لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدتُّمْ عَلَيْنَاۖ قَالُوٓا۟ أَنطَقَنَا ٱللَّهُ ٱلَّذِىٓ أَنطَقَ كُلَّ شَىْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ 

‘তারা যখন জাহান্নামের কাছে পৌঁছাবে, তখন তাদের কান, চোখ ও ত্বক তাদের কর্মসম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? ত্বক বলবে, যে আল্লাহ সবকিছুকে বাক্শক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরও বাক্শক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তারই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা হা-মিম, আয়াত : ২০-২১)

বিস্ময়কর হলেও সত্য, একজন প্রজার দেহে কাপড় নেই শুনে মন্ত্রী নিজের দেহের কাপড় খুলে রেখে দিলেন। আর খবর না আসা পর্যন্ত ওভাবেই প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে থাকলেন। এটাই ছিল আল্লাহভীরু মন্ত্রী ও শাসকদের দৃষ্টান্ত।

তারা জানতেন কেয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তা হলো তার জীবন সে কোন কাজে ব্যয় করেছে? যৌবন কোন কাজে শেষ করেছে? কোন পথে আয় ও ব্যয় করেছে? যেটুকু ইলম শিখেছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৬)

লেখক: মাওলানা মুহা. মুজিবুর রহমান 
পরিচালক, দ্যা  স্কলারস ফোরাম, ঢাকা,বাংলাদেশ।
 

পাঠকের মন্তব্য